Sunday, January 02, 2022

 আবোল তাবোলের 'হাতুড়ে' কবিতা


 |

'হাতুড়ে' কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় সন্দেশ পত্রিকার ১৯১৬ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর সংখ্যায় |
‘হাতুড়ে’ শব্দটি বাংলা ভাষায় কবে সমন্বিত হয় তা জানা যায় নি | শব্দটির বাগধারাগত অর্থ এমন সব ব্যক্তি যারা চিকিৎসাশাস্ত্রে জ্ঞান ও দক্ষতার দাবি করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রোগ নির্ণয়ে এবং নিরাময়ে অপটু অথবা অপারগ | শব্দটির উৎপত্তি রোগের উৎস সন্ধানে 'হাতড়ে' বেড়ানো থেকে, নাকি বারংবার হাতুড়ি ঠুকে কোনো যন্ত্র বা কলকব্জার গলদের উৎসসন্ধান (অথবা হাতুড়ির অন্ধ-ঘায়ে গলদ শোধরানোর আশা) থেকে, তা নিশ্চিতভাবে বলা দুস্কর |
কবিতাটি খুব সম্ভবত ভারতবর্ষে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের (Indian Civil Service) নবীন ব্রিটিশ আধিকারিকদের লক্ষ্য করে রচিত ব্যঙ্গাত্মক সামাজিক ভাষ্য | সেই সময়ে, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে এক সঙ্কটকাল উপনীত হয় – যে প্রসঙ্গ অনতিবিলম্বেই আলোচ্য |
কবিতার প্রথম প্রকাশনাকাল বিবেচনা করলে, 'হাতুড়ে' কবিতাটি সম্ভবত ১৯১৬ সালের গোড়ার দিকে রচিত | অর্থাৎ, কবিতাটি আবোল তাবোলের প্রথম-বিশ্বযুদ্ধকালীন-রচিত কবিতাসমষ্টির অন্তর্গত | স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে ১৯১৬ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, হঠাৎ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস সমন্ধে কবিতা কেন রচনা করবেন সুকুমার রায়? আবোল তাবোলের অন্যান্য অনেক কবিতায় দেখা গেছে যে নেহাত সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে ভাষ্য না হলে, সুকুমার রায়ের কবিতার ব্যঙ্গ বা ভাষ্যের লক্ষ্য ছিল সমসাময়িক কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা | অর্থাৎ, কবিতার বিষয় নির্বাচনের একটি সমসাময়িক প্রেরণা, প্ররোচনা বা কারণ ছিল | ১৯১৬ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস সমন্ধে কবিতা রচনার কোনো বিশেষ কারণ ছিল কি? ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের ইতিহাস খতিয়ে দেখলে জানা যায় যে ছিল |
সেই সময়ে, বস্তুতঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময় থেকেই, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে অভিজ্ঞ আধিকারিকের অভাব প্রকট হতে শুরু করে | এর অন্যতম কারণ অবশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধই | ১৯১৪ সালের ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৪৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথমে ১১ জন এবং তারপরে আরো ৩ জন, সরকারি চাকরির বদলে বেছে নেন দেশের প্রতি তাঁদের সামরিক দায়িত্ব | সেই কারণে সে বছরের নতুন আধিকারিকদের সংখ্যা এক ধাক্কায় ত্রিশ শতাংশ হ্রাসপ্রাপ্ত হয় | ১৯১৫ সাল নাগাদ এর প্রভাব ভারতবর্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যার তুলনায় সিভিল সার্ভিস আধিকারিকের অভাব রূপে অনুভূত হতে শুরু করে | প্রাককলিত হিসাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির সময় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের আধিকারিকবল ছিল প্রয়োজনের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম | দক্ষ আধিকারিকের অভাবে অনভিজ্ঞ নবীন আধিকারিকদের উপর ১৯১৫ সাল থেকেই ন্যস্ত হতে শুরু হয় ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব, এবং তা রীতিমত সঙ্গীন অবস্থায় পৌঁছায় ১৯১৬ সালে | সেকালের সংবাদমাধ্যমে এই বিষয় সমন্ধে আলোচনা হয়েছিল কিনা সে সংবাদ অনুসন্ধান করে ওঠা সম্ভব হয় নি, তবে আলোচনা হয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক |
স্বভাবতই, নবীন আধিকারিকবর্গ ছিলেন শাসন কার্য্যে অনভিজ্ঞ | 'হাতুড়ে' আখ্যান খুব সম্ভবত শাসন কার্য্যে তাঁদের হাতুড়ে ডাক্তার সুলভ অপটুতা অথবা অপারগতাকে ব্যঙ্গ করেই | অভিজ্ঞতার অভাবে নবীনেরা প্রায়শই পুরাতন নথিপত্র অবলম্বনে পূর্ববর্তী নজির বা দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নিতেন | পূর্ববর্তী নজির বা দৃষ্টান্ত সমসাময়িক বিচার্য্য বিষয়ের সঙ্গে কতটা প্রাসঙ্গিক সে সমন্ধে বিশেষ মাথাব্যথা, বা হয়তো সময়ও, তাঁদের ছিলনা | এ সমন্ধে শশী থারুর মহাশয় তাঁর ২০১৬ সালে প্রকাশিত 'দি আন-ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস' (The Un-Indian Civil Service; Open magazine, August 12, 2016) শিরোনামের প্রবন্ধে ইংরাজিতে লেখেন: "ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের প্রণালী ছিল যে কোনো মাপকাঠির বিচারেই চমকপ্রদ | চব্বিশ বৎসর বর্ষীয় নবীন জেলা-আধিকারিক আবিষ্কার করতেন যে তাঁর অধীনে ৪০০০ বর্গমাইল এলাকা এবং দশ লক্ষ জনতা | স্বভাবতই তাঁরা হয়ে পড়তেন 'পূর্ববর্তী পরোয়ানার' স্বৈরশাসনের শিকার |”
প্রবন্ধের সমর্থনে শশী থারুর হ্যারল্ড ফিল্ডিঙ-হল মহাশয়ের (যিনি স্বয়ং ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে ত্রিশ বৎসর আধিকারিক পদে নিয়োজিত ছিলেন) 'দ্য পাসিং অফ এম্পায়ার' (The Passing of Empire; Hurst & Blackett, Ltd., London 1913) নামক ১৯১৩ সালে প্রকাশিত ইংরাজিতে লেখা পুস্তক থেকে উধৃতি দেন: "শাসনাধীন জনসাধারণের প্রতি সরকারের মনোভাব সম্পূর্ণভাবে কলুষিত | [স্থানীয় পরিস্থিতির] জ্ঞান আর অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিচারবুদ্ধির অভাব দৃশ্যমান | পরিবর্তে আছে বর্তমান পরিস্থিতির ভ্রান্ত পরিমাপের, অথবা বর্তমান পরিস্থিতিতে অপ্রাসঙ্গিক পুরাতন পরিস্থিতির দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে কিছু বদ্ধমূল চিন্তাধারা – যেগুলির সংশোধন কোনোদিনই আর হয়ে ওঠেনা | নবীন আধিকারিকেরা পুরাতন কাগজপত্র থেকে জ্ঞানার্জনের অপচেষ্টা করেন, এবং সেগুলিতে নথিবদ্ধ সিদ্ধান্তগুলির ভুলভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি করে থাকেন | নিজেদের সিদ্ধান্তের সমর্থনে তাঁরা 'পূর্ববর্তী নজির অবলম্বনে' কাজ করছেন |"
১৯১৩ সালের এই অবস্থা যে ১৯১৬ সালের আধিকারিকবল-সঙ্কটের সময় আরো বর্ধিত আকারে অনুভূত হয়েছিল তার অনুধাবন বিশেষ কল্পনাশক্তির অপেক্ষা রাখেনা |
ফিল্ডিঙ-হল বর্ণিত 'পুরাতন কাগজপত্র' অবলম্বনে আধিকারিকদের কাজের পদ্ধতি কবিতায় অতি সহজেই "কাগজের রোগী কেটে আগে কর মক্‌স" হয়ে উঠতে বিশেষ বাধা নেই | ফিল্ডিঙ-হল বর্ণিত বর্তমান পরিস্থিতিতে অপ্রাসঙ্গিক বদ্ধমূল চিন্তাধারার প্রসঙ্গটিও "মোর কাছে ভেদ নাই, কলেরা কি ডেঙ্গু" পংক্তিটির বক্তব্য থেকে বিশেষ দূর বলা চলে না | উপরন্ত, আগেও লক্ষ্য করা গেছে যে সুকুমার রায়ের জ্ঞানানুরাগ এবং পড়াশোনা ছিল সুদূরপ্রসারী | ১৯১৩ সালে প্রকাশিত ফিল্ডিঙ-হল মহাশয়ের বইটি সুকুমার রায় স্বয়ং পড়ে থেকে থাকবেন এ সম্ভাবনাও একেবারে অগ্রাহ্য করা চলে না |
অবশ্য, অন্যান্য কবিতার বিশ্লেষণগুলির মতোই, এই ব্যাখ্যাটি বিশ্লেষকের অভিমত মাত্র | বিকল্প, এবং হয়তো অধিকতর গ্রহণযোগ্য, ব্যাখ্যা থাকতেই পারে | উপরের ব্যাখ্যাটিই যে যথাযথ, এমন কোনো দাবি নেই |
টীকা:
(১). ১৮৬০ সাল থেকেই অবশ্য ভারতীয়রাও ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরিক্ষায় বসতে শুরু করেছিলেন | তবে ১৯১৬ সালেও আধিকারিকদের অত্যধিকাংশ ছিলেন ইংরাজ |
(২). শশী থারুর মহাশয় তাঁর প্রবন্ধে মূল ইংরাজিতে 'পূর্ববর্তী পরোয়ানার' স্বৈরশাসনের সমন্ধে লিখেছিলেন tyranny of the Warrant of Precedence | বক্তব্য যথাযত হলেও Warrant of Precedence এর ব্যবহারটি ভ্রান্ত | Warrant of Precedence পূর্ববর্তী পরোয়ানা নামক এক 'ধারণা' নয় | চলিত ভাষায় Blue Book নামে পরিচিত, Warrant of Precedence বাস্তবে ছিল ক্ষুদ্র আকারের একটি পুস্তিকা, যেটি ব্যবহার করতেন, প্রধানত, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের আধিকারিকেরাই | পুস্তিকাটি ছিল স্বয়ং বড়লাট থেকে শুরু করে সর্বকনিষ্ঠ আধিকারিক পর্যন্ত পদমর্যাদার পূর্ববর্তীতার তালিকা | জানা যায় যে রাজকীয় সভায় অথবা ভোজের মেজে কে কোথায় বসবেন তা নির্ণয় করতে পুস্তিকাটি ছিল অপরিহার্য্য |
উৎস: 'আলোয় ঢাকা অন্ধকার' - নীলাদ্রি রায়, দে'জ পাবলিশিং ||

No comments: